দেশ সংযোগ

বৈসাবি ও পহেলা বৈশাখ উদযাপনের নামে পটকা বাজির ব্যবহারে বাড়ছে দুর্ঘটনা

 
বৈসাবি ও পহেলা বৈশাখ উদযাপনের নামে পটকা বাজির ব্যবহারে বাড়ছে দুর্ঘটনা জনসংযোগ

আরিফুল ইসলাম সিকদার

রুপসী বাংলার অন্যতম সৌন্দর্যময় অঞ্চল পার্বত্য অঞ্চল। নানা ভাষাভাষী ও ধর্মের সংমিশ্রণে একটি ভিন্ন সংস্কৃতি নিয়ে গড়ে উঠেছে এখানকার সাধারন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের চলমান ধারা।এই অঞ্চলের উপজাতি জনগোষ্ঠীর মানুষের শত উৎসবের মধ্যে প্রধান উৎসব ববর্ষবরণ।এ বর্ষবরণ উৎসবকে চাকমারা ‘বিজু’ মারমারা ‘সাংগ্রাই’এবং ত্রিপুরারা ‘বৈসু’ বলে অভিহিত করলেও পুরো পার্বত্য জেলায় তা ‘বৈসাবি’ নামেই পরিচিত।

বিজু চাকমা সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান আনন্দ-উৎসব। বাংলা বছরের শেষ দুই দিন ও নববর্ষের দিন এই উৎসব পালন করা হয়।

১২ এপ্রিল পালন করা হয় ফুলবিজু। এই দিন ভোরের আলো ফুটার আগেই ছেলেমেয়েরা বেরিয়ে পড়ে ফুল সংগ্রহের জন্য। সংগ্রহিত ফুলের একভাগ দিয়ে বুদ্ধকে পূজা করা হয় আর অন্যভাগ পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। বাকি ফুলগুলো দিয়ে ঘরবাড়ি সাজানো হয়।চৈত্র মাসের শেষ দিন অর্থাৎ‍ ১৩ এপ্রিল পালন করা হয় মুলবিজু। এইদিন সকালে বুদ্ধমূর্তি গোসল করিয়ে পূজা করা হয়। ছেলেমেয়েরা তাদের বৃদ্ধ দাদা-দাদী এবংনানা-নানীকে গোসল করায় এবং আশীর্বাদ নেয়। এই দিনে ঘরে ঘরে বিরানী সেমাই পাজন (বিভিন্ন রকমের সবজির মিশ্রণে তৈরি এক ধরনের তরকারি) সহ অনেক ধরনের সুস্বাদু খাবার রান্না করা হয়। বন্ধুবান্ধব আত্নীয়স্বজন বেড়াতে আসে ঘরে ঘরে এবং এসব খাবার দিয়ে তাদেরকে আপ্যায়ন করা হয়। সারাদিন রাত ধরে চলে ঘুরাঘুরি। বাংলা নববর্ষের ১ম দিন অর্থাৎ‍ ১৪ এপ্রিল পালন করা হয় গজ্যা পজ্যা দিন (গড়িয়ে পড়ার দিন)। এই দিনেও বিজুর আমেজ থাকে।

সাংগ্রাই বাংলাদেশী মারমা এবং রাখাইন জাতিগোষ্ঠীর নববর্ষ উৎসবের নাম,যা প্রতিবছর এপ্রিলের ১৩ থেকে ১৫ তারিখে পালিত হয়। যদিও এটি মারমাদের অন্যতম প্রধান একটি ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান, তবে রাখাইনরাও নিজস্ব নিয়মে সাংগ্রাইয়ের মাধ্যমে বর্ষবরণ করে নেয়।মারমাদের ক্ষেত্রে তাদের বর্মী বর্ষপঞ্জি অনুসরারেই এটি পালিত হয়। মারমাদের বর্ষপঞ্জিকাকে “ম্রাইমা সাক্রঃয়” বলা হয়। “ম্রাইমা সাক্রঃয়” এর পুরনো বছরের শেষের দুই দিন আর নতুন বছরের প্রথম দিনসহ মোট তিনদিন কে মারমারা সাংগ্রাই হিসেবে পালন করে থাকে। আগে “ম্রাইমা সাক্রঃয়” অনুযায়ী এই তিনদিন ইংরেজি ক্যালেন্ডারের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝিতে পড়লেও এখন ইংরেজি ক্যালেন্ডারের সাথে মিল রেখে এপ্রিলের ১৩,১৪ ও ১৫ তারিখে পালন করা হয়। ১৩ তারিখের সকালে পাঃংছোয়াই (ফুল সাংগ্রাই), ১৪ তারিখে প্রধান সাংগ্রাই আর ১৫ তারিখে পানি খেলার সাথে মারমাদের ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলোও অনুষ্ঠিত হয়।

অপরদিকে বৈসু বাংলাদেশ এবং ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর নববর্ষ উৎসব। চৈত্র মাসের শেষ দুইদিন এবং বৈশাখ মাসের প্রথম দিন এই তিনদিনব্যাপী এ উৎসব পালন করা হয়। প্রথম দিনকে বলা হয় হারি বৈসু, দ্বিতীয় দিনকে বৈসুমা এবং তৃতীয় বা শেষ দিনটিকে বলা হয় বিসি কতাল। মূলত আগামী দিনের সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা হয়।

তবে বর্তমানে উৎসবগুলো পালনের সেই পুরোনো ঐতিহ্য অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে।আধুনিকতার নামে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের পাশ্চাত্ত্য কালচার।তার মধ্যে অন্যতম হলো পটকা বা বাজি ফুটানো।শিশু থেকে শুরু করে কৈশোরত্তীর্ণ ছেলে মেয়ে এমনকি যুবক যুবতীদের অনেকেই এসব বাজি ফুটিয়ে আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে গিয়ে নিজের অজান্তেই নিজের ও পরিবেশের ক্ষতি করে বসেছে।কদিন আগে বরকলের হরিনা ইউনিয়নের রাঙাপানিছড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়টিও এই পটকা বাজির আগুনে পুড়ে গেছে।শুধু উপজাতিরাই নয় একই সাথে বাঙালী শিশুদের মাঝেও ব্যাপক বৃদ্ধি পাচ্ছে এইসব আতশবাজি ও পটকাবাজির।

এবার জানা যাক এইসব বাজি-পটকা পরিবেশ ও মানুষের জন্য কতটা ক্ষতিকর? বাজি-পটকার মধ্যে থাকে সহজদাহ্য মিশ্রণ। এতে ব্যবহার করা হয় পটাশিয়াম ক্লোরেট বা পটাশিয়াম নাইট্রেট। এ ছাড়া দাহ্যপদার্থ হিসেবে থাকে কাঠ-কয়লার গুঁড়ো, সালফার বা গন্ধক ইত্যাদি। মূলত এসব পদার্থগুলো আগুন জ্বলতে সহায়তা করে। কিন্তু বর্তমানে আরো একটি পদার্থ এই আতশবাজি, তুবড়ি বা হাওয়াই বাজি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। আর সেটি হলো বারুদ।

সাধারণত তুবড়ির খোলের মধ্যে বারুদ ঠেসে ভর্তি করে নেওয়া হয়। এর সঙ্গে লোহার গুঁড়ো বা অ্যালুমিনিয়াম-পাউডার মিশিয়ে নেওয়া হয়। তুবড়ির মুখে আগুন ধরিয়ে দিলে বারুদ জ্বলে ওঠে এবং জ্বলন্ত আগুন ফোয়ারার মতো ওপরে উঠে যায় আর আলোর ফুলকি ছিটকে বেরোতে থাকে। আতশবাজির নিচের দিকে থাকে বারুদ আর ওপরে নানারকম আতশবাজির মসলা। তাতে আগুন ধরিয়ে দিলেই তা প্রচণ্ড বেগে আকাশের দিকে ছুটে যায়।

এতে জ্বালানি হিসেবে কার্বন ও সালফার ব্যবহৃত হয়, যা পুড়ে গেলে কার্বন মনোঅক্সাইড,কার্বন ডাই-অক্সাইড,সালফার ডাই-অক্সাইড প্রভৃতি গ্যাস উৎপন্ন হয়। এসব স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকারক। কার্বন মনোঅক্সাইড গ্যাস ফুসফুসের মাধ্যমে শরীরের রক্তের সঙ্গে মিশে যায়। যা কার্বক্সিহিমোগ্লোবিন উৎপন্ন করে।
ফলে রক্তের অক্সিজেন পরিবহন করার ক্ষমতা বিনষ্ট হয়। তা ছাড়া মাথাধরা, ক্লান্তি ভাব এবং আর নানারকম উপসর্গও দেখা দেয়। সালফার ডাই অক্সাইড গ্যাস, শ্বাসনালি এবং ফুসফুসে ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে। তাছাড়া এ গ্যাস বাতাসে থাকলে তা বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে তৈরি করে সালফিউরাস ও সালফিউরিক অ্যাসিড। এসব অ্যাসিড ত্বকের ক্ষতিসাধন করে।

স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের মতে, বাজি-পটকা থেকে উৎপন্ন লেড বা সিসার অক্সাইডের বিষক্রিয়ায় রক্তশূন্যতা, দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অসাড়তা প্রভৃতি রোগ হতে পারে। অ্যান্টিমনি দূষণের ফলেও অনেকটা এ রকম হয়ে থাকে।
এছাড়া আর্সেনিক দূষণের ফলে দুরারোগ্য চর্ম রোগ এবং যকৃতের রোগ হতে পারে। শরীরবিদদের মতে, আর্সেনিকের বিষক্রিয়া শরীরের প্রভূতি ক্ষতিসাধন করতে পারে। ম্যাগনেসিয়াম প্রভৃতি ধাতু জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়া চালানোর জন্য খুবই প্রয়োজন। তবে এর মাত্রা বেশি হয়ে গেলে শরীরে দেখা দেয় নানা রকম বিপত্তি। আতশবাজি-পটকা থেকে নির্গত ধোঁয়ার সঙ্গে এসব পদার্থ প্রথমে ফুসফুসে যায়। তারপর রক্তের সঙ্গে মিশে যায়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর

 
Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker