সাহিত্য সংযোগ

চিরসবুজ মহিরুহ : আব্বাস আলী খান

চিরসবুজ মহিরুহ : আব্বাস আলী খান জনসংযোগ

সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে পরিচালিত যেকোনো আদর্শিক আন্দোলনকে সফলতার মনজিলে নোঙর করাতে এমন কিছু নিরলস পরিশ্রমী, অফুরন্ত প্রাণশক্তি ও হিম্মতের অধিকারী নিঃস্বার্থ সংগঠকের প্রয়োজন হয়, যারা নিজেদের সকল চাওয়া-পাওয়া, স্বপ্ন-সাধকে কুরবান করে আদর্শের জন্য কাজ করে যায়; কারও প্রশংসা-পুরস্কার কিংবা নিন্দা-তিরস্কারের পরোয়া না করে শত ঝড়-তুফানেও লক্ষ্যপানে দৃঢ়পদে সফর অব্যাহত রাখে। মরহুম আব্বাস আলী খান বাংলাদেশের সবুজ ভূ-খণ্ডে ইসলামি আদর্শ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে এমনই এক নিবেদিত নিষ্ঠাবান সংগঠক-নেতা-তাত্ত্বিক।

আব্বাস আলী খানের পূর্বপুরুষরা ছিলেন পাঠান। আফগানিস্তান থেকে তাঁর পূর্বসূরীরা এদেশে এসে জয়পুরহাটে বসতি স্থাপন করেছিলেন। জয়পুরহাটের সদর উপজেলার পারুলিয়া গ্রামে ১৩২১ বাংলা সনের (১৯১৪ ইং) ফাল্গুনের শেষদিকে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

১৯২১ সালে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সূত্রপাত হয় গ্রামের মাদ্রাসাতে। ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন পশ্চিমবঙ্গের হুগলির নিউ স্কিম মাদ্রাসার। ১৯৩০ সালে এ মাদ্রাসা হতে মেট্রিক পাশ করেন। ১৯৩২ সালে রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে আই.এ. এবং ১৯৩৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রংপুর কারমাইকেল কলেজ হতে ডিস্টিংশনে বি.এ. পাশ করেন।

শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবনে পা রাখেন আব্বাস আলী খান। কারমাইকেল কলেজ হতে বি.এ. পাশ করার পরপর রংপুর দারোয়ানি স্কুলে প্রধান শিক্ষক পদে নিযুক্ত হন তিনি।

১৯৩৬ সালের শুরুর দিকে ই.বি.আর. (ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট) এর একাউন্টস অফিসে নিয়োগ পান। নামাজে বাধা দেওয়ায় কয়েক মাস পর এ চাকুরিও ছেড়ে দেন। এরপর কিছুদিন বি.টি. অধ্যয়ন করেন। ১৯৩৬ সালের শেষ দিকে বন বিভাগের হেড অফিসে চাকুরিতে নিয়োগ হন। চাকুরির কারণে দার্জিলিং অবস্থান করেন। এখানেও তিনি বেশিদিন তিথু হতে পারেননি। ১৯৩৭ এর ১০ আগস্ট চাকুরি ছেড়ে দার্জিলিং থেকে চলে আসেন।

দার্জিলিং থেকে আসার পর ‘মিলিটারি সার্ভে অব ইন্ডিয়া’ অফিসে এক বছর চাকুরি করেন। এরপর বেঙ্গল সেক্রেটারিয়েট যোগ দেন। সাতচল্লিশের দেশ বিভাগের পূর্ব পর্যন্ত প্রায় এক দশক সচিবালয়ে কর্মরত ছিলেন তিনি। এ সময় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি দীর্ঘদিন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের একান্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৫২’র শেষদিকে জয়পুরহাট জেলা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক পদে যোগ দেন আব্বাস আলী খান। জামায়াতে ইসলামির সাংগঠনিক নির্দেশে ১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি শিক্ষকতার চাকুরি ছেড়ে সংগঠনের প্রয়োজনে সার্বক্ষণিক জনশক্তি নিয়োজিত হন।

বৈচিত্রময় কর্মজীবনের ঘাটে ঘাটে ঘোরার পর এত দিনে যেন মনজিলে মকসুদ খুঁজে পেলেন তিনি। অবশ্য মাঝখানে আইয়ুব খানের শাসনামলে সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ থাকাকালে ১৯৫৯ সালে কিছুদিনের জন্য আব্বাস আলী খান দিনাজপুর পাকহিলি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকও ছিলেন।

আব্বাস আলী খান তখন জয়পুরহাট জেলা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। ১৯৫৪ সালের ডিসেম্বর মাস। স্থানীয় মাদ্রাসার মাহফিলে কারমাইকেল কলেজের তৎকালীন অধ্যাপক জামায়াত নেতা জনাব গোলাম আযমের বক্তব্য শুনে তিনি আকৃষ্ট হন। তাঁরই দাওয়াত ও পরামর্শে স্থানীয় দায়িত্বশীল শেখ আমিনুদ্দীনের হাতে মুত্তাফিক (সহযোগী সদস্য) ফরম পূরণ করে ১৯৫৫তে আনুষ্ঠানিকভাবে জামায়াতে ইসলামিতে যোগদান করেন। ১৯৫৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে জামায়াতের রুকন (সদস্য) হন। তৎকালীন রাজশাহী বিভাগীয় আমীর অধ্যাপক গোলাম আযমের হাতে তিনি রুকন শপথ নেন। ১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি প্রথমবার কেন্দ্রীয় রুকন সম্মেলনে যোগদান করেন। সম্মেলনটি হয়েছিল বাহ্ওয়ালপুর রাজ্যের মাছিগোটে। সম্মলনের পরপর তাঁর ওপর রাজশাহী বিভাগীয় আমীরের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।

১৯৬২ সালের এপ্রিলে আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আব্বাস আলী খান নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৭১ সালে ডা. মালেক মন্ত্রীসভা গঠিত হলে আব্বাস আলী খান শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। স্বল্প সময়ের এ মন্ত্রীত্বে তিনি শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রয়োজনীয় ছাত্র সুবিধা নিশ্চিত করতে চেষ্টা করেন। ১৯৮৬’র নির্বাচনে আব্বাস আলী খান ঢাকার মতিঝিল আসন হতে দাঁড়িপাল্লা প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ১৯৯১ ও ১৯৯৬ এর জাতীয় নির্বাচনেও তিনি অংশগ্রহণ করেন।

১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে ডা. মালেক মন্ত্রীসভার সদস্যদের নিরাপত্তার জন্য রেডক্রুস হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তাদেরকে ৩১ জানুয়ারি, ১৯৭২ তারিখে গ্রেফতার করা হয়। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ধাক্কায় আব্বাস আলী খানও কারাজীবন শুরু করেন। ১৯৭৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরিন ছিলেন।

দাওয়াতী কাজ ও সাহিত্যচর্চায় অতিবাহিত হয় তাঁর ধুসর বন্দিত্বের দিনগুলো। তাঁর চমকপ্রদ আত্মজীবনী ‘স্মৃতী সাগরে ঢেউ’ রচিত হয় কারাগারে। ‘মৃত্যু যবনিকার ওপারে’ কারাভ্যন্তরে রচিত তাঁর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বই। কারামুক্তির পর তিনি সংগঠন গোছানোর কাজে আত্মনিয়োগ করেন। জামায়াতে ইসলামি সহ সকল ইসলামি দল তখন নিষিদ্ধ। শ্বাসরুদ্ধকর এ রাজনৈতিক পরিবেশে ভিন্ন পলিসি নিয়ে কার্যক্রম অব্যাহত থাকে ইসলামি আন্দোলনের।

১৯৭৯ সালের ২৫ মে তাঁর নেতৃত্বেই জামায়াতে ইসলামি বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়, তাই তাকে জামায়াতে ইসলামি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়ে থাকে। সংগঠনের আত্মপ্রকাশের প্রারম্ভ থেকে ১৯৯৪ এর জুন পর্যন্ত দীর্ঘ পনের বছর জামায়াতে ইসলামি বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত আমীরের দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন তিনি। ১৯৭৯ থেকে ইন্তেকাল পর্যন্ত ছিলেন জামায়াতের সিনিয়র নায়েবে আমীর।

সংগঠনের ভিত্তি মজবুতকরণ, দেশব্যাপী সংগঠন সম্প্রসারণ, স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলন, অধ্যাপক গোলাম আযমের নাগরিকত্ব পুনর্বহাল ইস্যু, ঘাদানিকদের ইসলাম ও ইসলামি আন্দোলন বিরোধী আদর্শিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আক্রমণ প্রতিহতকরণ প্রভৃতিতে তিনি সুদক্ষ নাবিকের মত শক্ত হাতে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

পাশাপাশি ইসলামি আন্দোলনের জনশক্তিদের তরবিয়ত, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক অগ্রসরতায় তাঁর ভূমিকা অবিস্মরণীয়। জীবনের গোধুলি লগ্নে আশি পেরুনো বয়সেও তিনি সংগঠনের প্রয়োজনে অক্লান্ত শ্রম বিনিয়োগ করেছেন। কোন রকমের ক্লান্তি কিংবা নিষ্ক্রিয়তাকে তিনি পশ্রয় দেননি। তাঁর আকাশসম উদার হৃদয়ের পরশে ও আন্তরিক সাহচর্যে জনশক্তিরা খুঁজে পেত অফুরান প্রাণপ্রাচুর্য।

সুদীর্ঘ ৮৫ বছরের বয়স ও ৪৪ বছরের সংগ্রামমুখর সাংগঠনিক জীবনের পর ১৯৯৯ সালের ৩ অক্টোবর রবিবার দুপুর ১:২৫টায় পৃথিবীর সফর শেষ করে আলমে আখিরাতে নতুন সফরের সূচনা করেন আব্বাস আলী খান।

৪ অক্টোবর বাদ জোহর পল্টন ময়দানে সালাতুল জানাযা অনুষ্ঠিত হয়, ইমামতি করেন আমীরে জামায়াত অধ্যাপক গোলাম আযম। নিজ জেলা জয়পুরহাটে মরদেহ নেয়ার পথে রাত পৌনে ২টায় বগুড়ায় ২য় জানাযা হয়। পরদিন জয়পুরহাট সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ময়দানে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর ইমামতিতে সম্পন্ন হয় শেষ জানাযা। নিজ বাড়ির আঙিনায় শেষ শয্যা পাতা হয় মরহুমের।

জনাব আব্বাস আলী খান সুসাহিত্যিক ছিলেন। সাহিত্য রসসমৃদ্ধ বাংলা ভাষা তাঁর আয়ত্বাধীন ছিল। এজন্য তাঁর রচনাবলি পাঠকের কাছে সুখপাঠ্য বিবেচিত হয়। কয়েকটি তাত্ত্বিক বই ছাড়া তাঁর অন্যান্য রচনায় রস ও আবেগের প্রাচুর্যে পাঠক আপ্লুত হন। বর্নাঢ্য জীবন অভিজ্ঞতার সরস বর্ণনা সমৃদ্ধ আত্নজীবনী ‘স্মৃতি সাগরে ঢেউ’ তাঁর অসাধারণ সাহিত্যকর্ম। ‘ঈমানের দাবী’, ‘ইসলামি আন্দোলনের কর্মীদের কাঙ্ক্ষিত মান’, ‘মৃত্যু যবনিকার ওপারে’ প্রভৃতি গ্রন্থ পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মতো রচনা।

আব্বাস আলী খানের তাত্ত্বিক বইগুলো তথ্য ও তত্ত্বসমৃদ্ধ। সে হিসেবে তিনি একজন গবেষক হিসেবে স্বীকৃত। ‘বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস’ তাঁর শ্রেষ্ঠ গবেষণাকর্ম। বাংলার মুসলমানদের সোনালী ও সংগ্রামমুখর অতীতের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসের সাবলীল বর্ণনাসমৃদ্ধ শ্রমসাধ্য এ গ্রন্থটি গবেষকশ্রেণি থেকে শুরু করে সাধারণ পাঠক পর্যন্ত সকলের কাছে সমাদর পেয়েছে। ‘ইসলাম ও জাহেলিয়াতের চিরন্তন দ্বন্দ্ব’ তাঁর আরেকটি মৌলিক চিন্তা ধারণকারী গ্রন্থ। তিনি অনুবাদেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। মৌলিক ও অনূদিত মিলিয়ে তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ত্রিশ।

 

আব্বাস আলী খান রচনাবলি

১. কুরআনের আলো (প্রথম বই ১৯৪৮)

২. ঈমানের দাবী

৩. মৃত্যু যবনিকার ওপারে

৪. ইসলাম ও জাহেলিয়াতের চিরন্তন দ্বন্দ্ব

৫. Muslim Ummah

৬. বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস

৭. ইসলামি আন্দোলন ও তার দাবী

৮. ইসলামি আন্দোলনের কর্মীদের কাক্সিক্ষত মান

৯. ইসলামি বিপ্লব একটি পরিপূর্ণ নৈতিক বিপ্লব

১০. একটি আদর্শবাদী দলের পতনের কারণ ও তার থেকে বাঁচার উপায়

১১. সমাজতন্ত্র ও শ্রমিক

১২. জামায়াতে ইসলামির ইতিহাস

১৩. জামায়াতে ইসলামির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

১৪. মাওলানা মওদূদী : একটি জীবন একটি ইতিহাস

১৫. আলেমে দ্বীন মাওলানা মওদূদী

১৬. মাওলানা মওদূদীর বহুমুখী অবদান

১৭. বিশ্বের মনীষীদের দৃষ্টিতে মাওলানা মওদূদী

১৮. স্মৃতি সাগরে ঢেউ

১৯. বিদেশে পঞ্চাশ দিন

২০. যুক্তরাজ্যে একুশ দিন

২১. দেশের বাইরে কিছুদিন

.

আব্বাস আলী খানের অনূদিত বই

১. আসান ফেকাহ (১ম ও ২য় খণ্ড)- মাওলানা ইউসুফ ইসলাহী

২. সীরাতে সরওয়ারে আলম (২-৫ খণ্ড)- মাওলানা মওদূদী

৩. আদর্শ মানব- মাওলানা মওদূদী

৪. ইসরা ও মিরাজের মর্মকথা- মাওলানা মওদূদী

৫. ইসলাম ও সামাজিক সুবিচার- মাওলানা মওদূদী

৬. পর্দা ও ইসলাম- মাওলানা মওদূদী

৭. পর্দার বিধান- মাওলানা মওদূদী

৮. ইসলামি অর্থনীতি- মাওলানা মওদূদী

৯. সুদ ও আধুনিক ব্যাংকিং- মাওলানা মওদূদী

১০. মুসলমানদের অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের কর্মসূচি- মাওলানা মওদূদী

১১. জাতীয় ঐক্য ও গণতন্ত্রের ভিত্তি- মাওলানা মওদূদী

১২. বিকালের আসর- মাওলানা মওদূদী

১৩. একটি ঐতিহাসিক সাক্ষাতকার- মাওলানা মওদূদী

 

লেখা: আবু সুফিয়ান (লেখক ও প্রকাশক)

 

আপনার পণ্য বা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিন এখানে

এ সম্পর্কিত আরও খবর

আপনার পণ্য বা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিন এখানে
Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker